শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ০৯:৪২ পূর্বাহ্ন
ষ্টাফ রিপোর্টার: গোপাল ভাঁড়ের একটি পরিচিত গল্প মনে পড়ছে। গোপালের একটি গরু হারিয়ে গিয়েছিল। চৈত্রের কাঠফাটা রোদে বনে-বাদাড়ে সারা দিন খুঁজেও গরু পেলেন না। খুব ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে দাওয়ায় বসে নিজের ছেলেকে গোপাল বললেন, ‘ভাইরে, তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি একগ্লাস জল দাও’।
গোপালের স্ত্রী রান্নাঘরে ছিলেন। স্বামীর কথা শুনে তিনি বললেন, ‘তোমার এত বয়স হল অথচ একটু কাণ্ডজ্ঞান যদি থাকত। নিজের ছেলেকে কেউ ভাই ডাকে?’ স্ত্রীর তিরস্কারে একটুও বিচলিত হলেন না গোপাল। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন স্ত্রীকে- ‘সাধের গরু হারালে এমনই হয় মা!’
গল্পের মর্মার্থ হচ্ছে- বিপদে পড়লে মানুষ কাণ্ডজ্ঞান হারায়। করোনার দিনগুলোতে এটি আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। করোনাকাণ্ড অনেক ক্ষেত্রে আক্রমণ করেছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে কাণ্ডজ্ঞান।
করোনার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ওঠার জন্য সরকার যখন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করল তখন দলেবলে মানুষ কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ‘সামাজিক দূরত্ব’ বলতে তারা নিশ্চয়ই ঘরের সঙ্গে দূরত্ব রক্ষাকে বুঝেছিলেন। ঘর থেকে শুধু দু’পা নয়- অজস্র পা ফেলিয়া তারা কক্সবাজারে চলে গেলেন। প্রশাসনকে হিমশিম খেতে হয়েছে তাদের ঘরমুখী করার জন্য।
লকডাউনের সময় জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ফার্মেসিগুলো খোলা রাখা হয়েছিল যেন রোগীরা প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র কিনতে পারেন। ঘরবিমুখ মানুষ এটিকে সুযোগ হিসেবে নিয়েছে। পকেটে প্যারাসিটামল/নাপা এমনকি জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন দিনের পর দিন।
বেচারা পুলিশের সাধ্য কী যে তাদের আটকায়। কাণ্ডজ্ঞানের অভাব থাকলেও জ্ঞানের অভাব নেই কোনো কোনো এলাকাবাসীর। বরাবরের মতোই তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে মারামারি-লাঠালাঠি করেছেন তারা। কেউ কেউ বলেছেন মারামারির আগে ও পরে তারা অস্ত্রশস্ত্রে স্যানিটাইজার লাগিয়েছেন এবং বাড়ি ফিরে গোসল করেছেন। কলহপ্রিয় হলেও তারা যে স্বাস্থ্যসচেতন এবং এ সংক্রান্ত জ্ঞানের অধিকারী- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাঙালি ক্রীড়ামোদী জাতি।
করোনার এ দুঃসময়কে উপেক্ষা করে দু’টি বিচিত্র নামের ফুটবল দলকে গফরগাঁওয়ের এক গ্রামে ফুটবল খেলতে দেখা গেছে। দল দু’টির নাম- ‘করোনা পজিটিভ’ ও ‘করোনা নেগেটিভ’। ক্রীড়ার অন্যতম উদ্দেশ্য- দলীয় সংহতি গঠন। করোনায় আক্রান্ত ও সুস্থদের এমন দল গঠনের ইতিহাস মানব ইতিহাসে প্রথম।
আক্কেল শব্দের আভিধানিক অর্থ- বিবেক বা কাণ্ডজ্ঞান। জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে বিচিত্র আক্কেলের বহির্প্রকাশ ঘটেছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে আইসোলেশন ইউনিটে আক্রান্ত রোগীর কাছে চিকিৎসক ও নার্স ছাড়া কেউ যেতে পারেন না। কিন্তু আক্কেলপুরের এক ব্যক্তি এ নিয়ম মানেননি। সব বাধা তুচ্ছ করে তিনি জোর করে আইসোলেশন ইউনিটে আক্রান্ত স্ত্রীর সঙ্গে থেকেছেন।
এখানেই শেষ নয়- আক্কেলগুড়ুম হওয়ার মতো আরেকটি ঘটনা ঘটেছে আক্কেলপুরে। আইসোলেশন ইউনিটের দ্বিতীয় তলায় ভর্তি থাকা তরুণী তৃতীয় তলায় আক্রান্ত যুবকের প্রেমে পড়েছেন। তাদের এখানে রাখা হয়েছিল করোনাভাইরাসের চিকিৎসা দেয়ার জন্য। সবার নিষেধ অমান্য করে আক্রান্ত তরুণ-তরুণী দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন। সব বাধা তুচ্ছ করে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। বাংলা সিনেমার নাম সত্যিই সার্থক- প্রেম মানে না বাধা।
করোনাকাণ্ডের বিচিত্র প্রভাব শুধু বাইরে নয়- ঘরেও পড়েছে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এ প্রথম কোনো ঘটনা স্বামী-স্ত্রীকে এতদিন এতকাছে এবং প্রেমিক-প্রেমিকাকে দূরে রাখতে পেরেছে। গৃহবন্দি পুরুষের উপলব্ধি- করোনাকে ভয় পাওয়া যাবে না, করোনার সঙ্গে লড়াই করতে হবে।
স্ত্রীর সঙ্গে লড়াই করা যাবে না, তাকে ভয় পেতে হবে। এ দু’টিকে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। কারণ করোনা ও স্ত্রী- কোনোটিরই ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। আর গৃহস্থালি কর্মে পুরুষদের অঘটনঘটনপটিয়সী প্রতিভা দেখে স্ত্রীজাতির উপলব্ধি- স্বামী ছাড়া তবু চলে কিন্তু গৃহকর্মী ছাড়া চলে না।
স্ত্রীর হেফাজতে থাকা স্বামীরা যখন জামিনের প্রহর গুনছেন তখন পরিবার পরিকল্পনা দফতরের এক চাকুরে স্বেচ্ছায় অন্তরীণ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। লকডাউনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা না মেনে তিনি ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে গণজমায়েত করে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরেছেন। কর্তৃপক্ষ তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন। বিয়ের মতো মহান কর্ম সম্পাদন করতে গিয়ে চাকরি হারানোর এমন নজির কারো নেই। তবে কাণ্ডজ্ঞানহীনতার যাবতীয় রেকর্ড ভঙ্গ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে সারা বিশ্ব যখন আতঙ্কিত তখন তিনি এক মোক্ষম দাওয়াই দিলেন।
তিনি বললেন, করোনা পরীক্ষা বন্ধ করে দিলেই রোগীর সংখ্যা কমে যাবে। কী যুগান্তকারী আবিষ্কার! এর আগে ট্রাম্প নোবেল পুরস্কার না পাওয়ায় নোবেল কমিটিকে ভর্ৎসনা করেছিলেন। করোনা রোগী হ্রাসের এ উপায় আবিষ্কারের জন্য তিনি এ বছরের নোবেল দাবি করতেই পারেন।
করোনার প্রভাব ঈদ উৎসবেও পড়েছে। গৃহকর্তারা খুশি ছিলেন লকডাউনে শপিংমল বন্ধ থাকায়। গিন্নিরা ছিলেন বিমর্ষ। হঠাৎ শপিংমল খুলে যাওয়ায় চিত্র উল্টে গেল। স্বামীদের বিমর্ষ করে স্ত্রীরা আনন্দে ছুটে গেলেন শপিং করতে। নিন্দুকেরা অবশ্য বলছেন, যেসব স্বামী করোনাদুর্যোগে তাদের স্ত্রীদের শপিংয়ে যেতে দিতে রাজি হয়েছেন তাদের উদ্দেশ্য মহৎ নয়। তাদের ইচ্ছা আগামী ঈদে নতুন স্ত্রীর সঙ্গে শপিং করা।
উৎসবের সঙ্গে অন্য সাধারণ দিনের পার্থক্য চিহ্নিত করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী- কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ; সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ’। মানুষের সম্মিলনের ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর ঈদ উৎসব করোনাকালে বিচ্ছিন্নতার আবহ ধারণ করেছে। উৎসবের আমেজ অনুপস্থিত।
করোনাকাণ্ডে যে মানুষ বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণায় ছটফট করছে এর কারণ মানুষ সামাজিক জীব। উৎসব সেই সামাজিকতারই ঘনীভূত রূপ। বৈশ্বিক মহামারী করোনা এ বার্তা দিয়েছে, শুধু মানুষের জন্য পৃথিবী নয়। উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণী মিলে যে ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে- সেটি নষ্ট করে মানুষ উৎসবের আনন্দ উদযাপন করতে পারে না। প্রকৃতি ও পরিবেশ বিপন্ন করে মানুষ সুস্থ থাকতে পারে না। ঈদ-উল-আজহার প্রকৃত মর্ম হচ্ছে- উৎসর্গ বা ত্যাগের মানসিকতা অর্জন।
প্রতিটি ধর্মই ভোগের পরিবর্তে ত্যাগকে প্রধান্য দিয়েছে। ঈদের তাৎপর্য অনুধাবন করে যদি লাগামহীন ভোগবাদী মানসিকতাকে বর্জন করা যায় তবে শুধু করোনা নয়- অন্য মহামারী থেকেও মুক্ত থাকা সম্ভব হবে।