শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ০৯:৪৬ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম :
বাংলাবাজার খবর অনলাইন নিউজ পোর্টালের জন্য দেশের প্রতিটি জেলা উপজেলা ও বিভাগীয় শহরে সাংবাদিক নিয়োগ চলছে। journalist.hadi@gmail.com এবং newsbbazer@gmail.com এই ইমেইল দুই কপি ছবি ও দুইটি নমুনা প্রতিবেদনসহ জীবনবৃত্তান্ত পাঠাতে পারেন। বিভাগীয় শহরে ব্যুরো অফিস দেওয়া হবে।

করোনা জয় করেই মাঠে পুলিশ॥ মানবিকতায় অনন্য দৃষ্টান্ত

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ॥
অতীতে দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ থাকলেও করোনা মহামারীতে মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে প্রশংসায় ভাসছে পুলিশ। নিজেরা করো না আক্রান্ত হয়েও তাকে জয় করে এরইমধ্যে দৃপ্ত মনোবল নিয়ে পুনরায় কাজে ফিরেছে পুলিশের অধিকাংশ সদস্য।
গত ৩০ এপ্রিল করোনা আক্রান্ত হন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ট্রফিক-পূর্ব) জেমরা জোনের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম। বাসায় ফিরলে পরিবারের অন্যরাও সংক্রমিত হতে পারেন এমন আশংকায় সার্বক্ষনিক অফিসেই অবস্থান করছেন। এখনো নিগেটিভ রিপোর্ট হাতে পাননি। তবে সুস্থবোধ করায় গত কয়েকদিন ধরে এসি রবিউল তার অফিসিয়াল দায়িত্বও পালন করে যাচ্ছেন। করোনায় আক্রান্ত ছিলেন, কিন্তু নিগেটিভ রিপোর্ট আসার পর কেউ কাজে যোগ দিয়েছেন কি না গতকাল বিকেলে এমন প্রশ্নের জবাবে উপরের তথ্যগুলো দেন ডিএমপি’র উপকমিশনার (ট্রাফিক-পূর্ব) মো. সাহেদ আল মাসুদ।
পরবর্তীতে কথা হয় এসি রবিউল ইসলামের সঙ্গে। দীপ্ত কন্ঠেই তিনি বলছিলেন, ভাই আল্লাহ সুস্থ রেখেছেন এখনো। পজিটিভ রিপোর্ট পাবার পর একদিন রাজারবার কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে (সিপিএইচ) ভর্তি হয়েছিলাম। তবে পরদিন অফিসেই ফিরে এসে কোয়রিন্টেনে থাকি। সার্বক্ষনিক চিকিৎসকদের পরামর্শেই ছিলাম। আজ (মঙ্গলবার) নমুনা দিয়ে এসেছি। আশা করছি নেগেটিভ রিপোর্ট আসবে।
ডিএমপি’র ট্রফিক পশ্চিম বিভাগের সহকারী উপপরিদর্শক মো. ফিরোজ কবীর। থাকেন ডিএমপি’র পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট-‘পিওএম’ এর ট্রাফিক ব্যারাকে। গ্রামের বাড়ী গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে। গত ১৩ এপ্রিল করোনা পজিটিভ হয়ে সিপিএইচ-এ ভর্তি হয়েছিলেন। পরবতীতে ২৮ তারিখ নিগেটিভ রিপোর্ট আসার পর কয়েকদিন কতৃপক্ষের নির্দেশে বিশ্রাম নেয়ার পরই ফিরেছেন কাজে যোগ দিয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ফিরোজ কবীরের। তার কথায়ই বুঝা যাচ্ছিলো কতটা শক্ত মনের অধিকারী তিনি। দীপ্ত মনোবল নিয়ে এখনো দায়িত্ব পালন করছিলেন। বলছিলেন, ভাই আমরা জেনে শুনেই পুলিশ বহিনীতে যোগ দিয়েছি। রোগ সৃষ্টিকর্তার আদেশেই হয়। তবে আমি অসুস্থ থাকা কালীন সময়ে আমার সিনিয়র স্যারেরা সবসময় আমার খোঁজ খবর নিয়েছেন। মানসিক শক্তি জুগিয়েছেন।

দেশে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত নতুন করে ১২৮ জন নিয়ে সারাদেশে এ পর্যন্ত পুলিশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৪৯ জনে। ৯ পুলিশ সদস্য করোনার কাছে পরাজিত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। তবে সুস্থ হয়ে উঠেছেন মোট ৪৩০ পুলিশ সদস্য। এই ৪৩০ জনের মধ্যে অনেকেই এরইমধ্যে তাদের কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন। কাজে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন অনেকেই। তাদেরই একজন করোনাজয়ী পুলিশ কনস্টেবল মুকুল মিয়া। কর্মরত ডিএমপি’র ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগে। তিনিও থাকেন পিওএম ব্যারাকে। তার উপলব্ধি হলো, এখনো অনেকেই করোনা নিয়ে সচেতন নন। যার যার জায়গা থেকে আরও সচেতন থাকা দরকার। সুস্থ হওয়ার পর হাসপাতাল থেকে ব্যারাকে ফিরে এসেছি। আবার কাজে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায় আছি।

এদিকে, পুলিশ সদস্যদের পুলিশ লাইন্স কিংবা ব্যারাকে থাকার পরিবেশ নিয়ে অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞই বিরূপ মন্তব্য করেছেন। বর্তমান এই মহামারির সময়েও পুলিশ সদস্যদের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত না করা এবং বিভিন্ন ব্যারাক এবং ইউনিটের আবাসস্থলের দৃশ্য তাদের ভাবিয়ে তুলছে। তারা বলছেন, মানবিক পুলিশ হিসেব নিজেদের জানান দিলেও কঠিন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালন এবং ব্যারাক কেন্দ্রিক গাদাগাদি করে বসবাসের কারনে পুলিশ বাহিনীর প্রায় প্রতিটি সদস্যই করোনা সংক্রমণের তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছেন।

বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রোভিসি অধ্যাপক রশীদ ই মাহবুব বলেন, দেখুন এই মহামারিতে অবশ্যই পুলিশ সদস্যদের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে। ব্যারাকে গাদাগাদি করে বসবাস করলে নিশ্চিত হবার আগেই জীবানু অনেকের শরীরে তা সংক্রমিত হয়ে যেতে পারে।

তবে পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমরা পর্যায়ক্রমে সব ধরনের সুরক্ষা সুবিধা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করা সদস্যের জন্যও আমরা এরই মধ্যে পুলিশের মনোগ্রাম সম্বলিত পিপিই-সহ নানা ধরনের সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করেছি। এখন পুলিশের উদ্যোগে তৈরী উন্নমানের মাস্ক সরবরাহ করা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, দেখুন রাতারাতি সব কিছু পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তারপরও আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুসারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ ক্রমে সমস্যাগুলো সমাধান করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এরইমধ্যে করোনা আক্রান্ত এবং কোয়ারেন্টিনে থাকা সদস্যদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতের জন্য বিভিন্ন ডরমেটরী এবং হোটেল এমনকি হাসপাতাল ভাড়া করা হয়েছে। একইসঙ্গে অপ্রয়োজনীয় ডিউটি কমিয়ে মোবাইল ডিউটি বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এবার পেশাগত দায়িত্বের বাইরে গিয়ে পুলিশ সদস্যরা মানবিক বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে।

জানা গেছে, রাজারবাগ সিপিএইচ ছাড়াও ঢাকায় বেসরকারী ইমপালস হাসপাতাল, ট্রাফিক ব্যারাক চিকিৎসা কেন্দ্র ও রাজারবাগ স্কুুল অ্যান্ড কলেজকে রিকভারি সেন্টার করা হয়েছে। উপসর্গ থাকা এমনকি করোনা আক্রান্তদের সংস্পর্শে ছিলেন এমন পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন পুলিশ লাইন্স থেকে সরিয়ে আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল, দিয়াবাড়িতে প্রস্তাবিত পুলিশ লাইন্সের অস্থায়ী ক্যাম্প, রায়েরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি, ডিবি ব্যারাকসহ ৩৫-৪০টি পৃথক জায়গায় রাখা হয়েছে। বিভাগীয় শহরে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত বেসরকারি হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অসুস্থ পুলিশ সদস্যদের দেখাশোনার জন্য উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে ‘বিশেষ টিম’। ইউনিটগুলোর কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে আলাদা টিম গঠন করে পর্যায়ক্রমিকভাবে দায়িত্বে পাঠানো হচ্ছে। ৫০ বছরে বেশি বয়সের সদস্যদের খুব প্রয়োজন না হলে অফিসে/থানার বাইরে ডিউটিতে পাঠানো হচ্ছে না।

আরেক করোনা যোদ্ধা ডিএমপি ট্রফিক পূর্ব বিভাগের ইন্সপেক্টর মোহা: হোসেন জাকারিয়া মেনন (৪৬)। গ্রামের বাড়ী কুষ্টিয়ার দৌলতপুর। গত ৩০ এপ্রিল থেকে জ্বর আসলে ৪ মে নমুনা পরীক্ষা করতে দেন। ৭ মে করোনা পজিটিভ জানার পর থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পল্লবীর ভাড়া বাসাতেই আইসোলেশনে রয়েছেন তিনি। বাসায় তার স্ত্রী, ১ মেয়ে ও ১ ছেলে। কবে কাজে যোগ দিবেন সেই দিন গুনছেন তিনি। গতকাল রাতে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কবে যে নেগেটিভ রিপোর্ট আসবে তার প্রতীক্ষায়। এর পরদিনই কাজে যোগ দিতে চাই। এতোদিন বাসায় বসে থাকা যায়? প্রথম ৪/৫ দিন একটু সমস্যা হয়েছিলো। তবে এরপর থেকে সুস্থবোধ করছি। স্বামী পুলিশ হওয়ায় প্রতিকূলতা মোকাবেলা করার কারনে দিনকে দিন আমার স্ত্রীও অনেক সাহসী হয়ে উঠেছে। সন্তানদের মনোবলও অনেক দৃঢ়।

সিপিএইচ এ দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সান্তু। প্রতিমূহুর্তে দেখছেন করোনা আক্রান্ত কিংবা আইসোলেশনে থাকা পুলিশ সদস্যদের স্থান সাংকুলন করতে কতৃপক্ষকে গলদঘর্ম হওয়ার চিত্র। তবে সার্বক্ষনিকভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামনে থেকে এই কর্মকর্তা অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসার সমন্বয় টিমে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। সুস্থ হয়ে উঠা পুলিশ সদস্যদের হাসিমুখে ফুল দিয়ে বিদায় জানাচ্ছেন। গতকাল সন্ধ্যায় কথা হয় এই কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ইমপালস্্ হাসপাতাল ভাড়া করার প্রথম দিনেই পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এর আগে চিকিৎসার জন্য কতৃপক্ষ ব্যারাক, ডিটিএস, সিদ্ধেশ্বরী কলেজসহ অনেক খালি স্থাপনা আমরা ব্যবহার করে ফেলেছি। তাই সরকারের অর্থ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে সিপিএইচ এর নিকটবর্তী অব্যবহৃত কিংবা নতুন নির্মিত ভবন যা এখনো বরাদ্ধ দেয়া হয়নি তা সাময়িকভাবে ব্যবহারের সুবিধা পেলে সমস্যার অনেক লাঘব হতো।

জানা গেছে, পুলিশের সদস্য সংখ্যা দুই লাখ ১২ হাজারের মধ্যে ডিএমপি’র ফোর্স প্রায় ৩৪ হাজার। এখনো পর্যন্ত সারাদেশে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে অর্ধেকই হলো ডিএমপি’র সদস্য। আর পুলিশের মধ্যে যারা করোনায় আক্রান্ত তাদের মধ্যে অনেকেই বাহিনীর ট্রাফিক বিভাগ এবং পরিবহন পুলের সদস্য।

পরিবহন পুলের সদস্য করোনা আক্রান্ত কনস্টেবল মনির হোসেন। পুলিশের মধ্যে তিনিই প্রথম ব্যক্তি। ৪ এপ্রিল ফোর্স নিয়ে দয়াগঞ্জ, মিলব্যারাক এলাকায় ডিউটিতে যান তিনি। ডিউটি শেষে বাসায় ফেরার পরই গলাব্যথা ও জ্বরে ভোগেন। ৮ এপ্রিল নুমনা দিয়ে ১১ এপ্রিল জানতে পারেন তিনি করোনা পজিটিভ। বর্তমানে সুস্থ হয়ে বাসায় বিশ্রামে আছেন।

ডিএমপিতে এতো বেশী আক্রান্ত কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (সদর দপ্তর) শাহ মিজান শাফিউর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের কাজের ধর্মই হলো মাুনষের কাছে যাওয়া। চলমান এই মহামারীতে সংক্রমন ঠেকাতে লকডাউন বাস্তবায়ন এবং আইন শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে এর বিকল্প নেই। এরপরও পুলিশ সদস্যরা দমে যায়নি। পেশাগত দায়িত্বের বাইরে গিয়েও মানুষের পাশে দাড়িয়েছে। যেখানে করোনা সন্দেহে লাশ রেখে তার স্বজনেরা পালিয়েছে। লাশের গোসল করানো, দাফন/সৎকারের ব্যবস্থা করছে পুলিশ। অসুস্থ রোগীকে পুলিশের গাড়ীতে করেই হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। অসহায় মানুষের খাবার পৌছে দিচ্ছে। মাঠে থেকে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে বলেই পুলিশ সদস্যরা বেশি সংক্রমিত হচ্ছেন। তবুও পিছু হঠছে না পুলিশ সদস্যরা।

Spread the love

এই পোস্টটি আপনার সামাজিক মিডিয়াতে ভাগ করুন

© All rights reserved © 2019
Design & Developed BY আইটি হোস্ট সেবা